দেশজুড়ে ডেস্ক: দীর্ঘ ১২ বছর পেরিয়ে গেছে। পাবনার ঈশ্বরদী বেনারসিপল্লীতে এখনো গড়ে ওঠেনি তাঁতিদের পূর্ণাঙ্গ কারখানা। পল্লী গড়ে ওঠার সময় তাঁতিদের মনে যে আশার আলো জেগেছিল, এখন তা ভেস্তে যেতে বসেছে। অথচ এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেনারসিপল্লী হিসেবে পরিচিত।
উত্তরবঙ্গে কর্মরত কয়েক হাজার বেনারসি তাঁতিদের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা, তাঁতশিল্পের প্রসার ও তাঁতিদের জীবনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে তাঁত বোর্ড ঈশ্বরদী বেনারসিপল্লী স্থাপনের জন্য প্রকল্প হাতে নেয় ৯০ দশকে। ওই প্রকল্পের আওতায় সর্বপ্রথম মিরপুর বেনারসিপল্লী গড়ে ওঠে। এরপর উদ্যোগ নেওয়া হয় ঈশ্বরদী বেনারসিপল্লী গড়ে তোলার। ১৯৯৮-৯৯ সালে জরিপের কাজ শুরু হয়। ২০০০ সালে বেনারসিপল্লী স্থাপনের জন্য ঈশ্বরদীর ফতেমোহাম্মদপুরে এডিপির দুই কোটি ১৬ লাখ টাকার অর্থায়নে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। তাঁতিদের সুবিধার জন্য এখানে রাখা হয় পানি, বিদ্যুৎ, নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ নানা ব্যবস্থা। ২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর সাড়ে পাঁচ একর জমির ওপর প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। পল্লীতে ২০টি পাঁচ কাঠার প্লট ও পরবর্তীকালে ৭০টি তিন কাঠার প্লটের মধ্যে উদ্বোধনের দিন ৫৭ প্লট তাঁতিদের মধ্যে স্থানান্তর করা হয়। পাঁচ কাঠার প্লটের মূল্য ৭৫ হাজার ৩০০ টাকা এবং তিন কাঠার প্লটের মূল্য ৪২ হাজার ২৭৫ টাকা ধরা হয়। যা ২৪০ কিস্তিতে সহজ শর্তে পরিশোধ করতে হবে।
মাস্টার প্লান অনুযায়ী প্রতিটি শিল্প প্লটের নিচতলা কারখানা ও ওপরতলা আবাসিক ভবন করার কথা। কিন্তু তাঁতিদের আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তা শিথিল করা হয়। পরে টিনশেড ভবনের সামনে কারখানা ও পেছনে আবাসিক ভবন নির্মাণের অনুমোদন পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে ৪ জানুয়ারি পল্লীতে একজন তাঁতি কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেন। ২০০৮ সালের জুলাই পর্যন্ত কারখানা নির্মাণের কাজ শুরু করেন ছয়জন তাঁতি। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পানি, গ্যাস সরবরাহ না থাকায় ও মূল নকশা অনুযায়ী স্থায়ী কারখানা গড়ে না ওঠায় তাঁতিদের মাঝে হতাশা বিরাজ করতে শুরু করে। তবু মূল নকশা ও প্রকল্প নির্দেশনার বাইরে ৯টি অস্থায়ী কারখানা গড়ে উঠলেও চালু রয়েছে আটটি। আর্থিক সংকটের কারণে সেই কারখানাগুলোও চালু রাখা যাবে কি-না তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন কারখানা মালিক-শ্রমিকরা।
তাঁতিরা জানান, পল্লীর প্রসার ও আর্থিক উন্নতির জন্য বেনারসিপল্লী উদ্বোধনের কয়েকটি দাবি তারা তুলে ধরেছিলেন। ২০ বছর মেয়াদে ২৪০ কিস্তিতে সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ এবং সরকারি অর্থায়নে বেনারসিপল্লীর প্লটে কারখানা ও আবাসন নির্মাণ, সাঁথিয়ার পরিবর্তে ঈশ্বরদীর তাঁতিদের জন্য একটি বেসিক সেন্টার ও ক্যালেন্ডার মেশিন স্থাপন করা। কিন্তু তাঁত বোর্ড তাদের সেই দাবি মানেনি বলে অভিযোগ করেন তারা। বেনারসিপল্লীতে প্লট নিয়েছেন এমন কয়েকজন তাঁত মালিক জানান, এমনিতে তাদের চলতি মূলধনের অভাব রয়েছে, এতে তাঁত টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বেনারসিপল্লীতে নকশা অনুযায়ী প্রতিটি কারখানা ও আবাসন নির্মাণের জন্য ১৫ লাখ টাকা তারা কোথায় পাবেন? এত টাকায় কারখানা নির্মাণ কি তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব?
তাঁত মালিক নাসিম আহমেদ বলেন, ‘অর্থ সংকটের কারণে প্রায় ২৫টি তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। বেনারসিপল্লীতে কারখানা করলে সরকার সহযোগিতা করবে এ আশায় অনেকে প্লট ক্রয় করেছিলেন। সরকারি কোনো সহযোগিতা না পাওয়ায় কারখানা তৈরির আশা ছেড়ে দিয়েছি। ‘ সরেজমিনে দেখা গেছে, স্থায়ী কারখানা নির্মাণ না হওয়ায় পল্লীর ভেতর গড়ে উঠেছে কাশবন, গরু-ছাগল চরানো হচ্ছে, ধান শুকানো হচ্ছে এমনকি খেলাধুলাও হয়ে থাকে। মূল ফটক দেখে বোঝা যায় না এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেনারসিপ্রকল্প। পল্লীর ভেতর বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন করা হয়েছে। পানি সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা নেই। ভেতরে মসজিদ থাকার কারণে নামাজের সময়ই শুধু মুসল্লিদের দেখা যায়, বাকি সময় নীরব নিস্তব্ধ।
তথ্যমতে, বাংলাদেশে সর্বপ্রথম পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে কয়েকজন রেল কর্মকর্তার উদ্যোগে বেনারসিশিল্প গড়ে ওঠে। ওই রেল কর্মকর্তারা ছিলেন বেনারসের বাসিন্দা। তাদের পূর্বপুরুষেরাও এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারা রেলওয়ে চাকরির সুবাধে ঈশ্বরদী অঞ্চলে আসেন। ওই সময় রেলওয়ের চাকরিতে সংসার চালানো কষ্টকর ছিল। সংসারের অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহন করতে নিজেদের রেলওয়ের আবাসিক বাসাবাড়িতে আলীজান, রোজান মিয়া, আমিন উদ্দিন, আমানত খান প্রথম বেনারস থেকে তাঁত নিয়ে আসেন। তার কিছুদিন পর আসেন আব্দুল মজিদ ও কামরুদ্দিন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় আলী, আমানত খান ও কামরুদ্দিন তাদের তাঁত বিক্রি করে বেনারসে চলে যান। আর রোজান মিয়া চলে যান ঢাকার মিরপুরে। পাবনার দাশুড়িয়ার মুদি দোকানদার হানিফ ওই সময় রেল কলোনিতে থাকতেন। তিনি ভাড়ায় কারিগর নিয়োগ করে তাঁতের কাজ শুরু করেন ৬০ এর দশকে। ঈশ্বরদীতে গেঞ্জির টিকিট লাগানো লেবেল বানানোর মধ্য দিয়ে কাজ শুরু হয়। ওই সময় পাবনায় গেঞ্জির কদর ছিল। পরে শুধুমাত্র শাড়ির পাড় বানানো হতো। তারপর কয়েকজন উদ্যোমী শাড়ির কাজ শুরু করেন। দেখতে দেখতে ঈশ্বরদী লোকোশেড এলাকা বেনারসিপল্লী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ঈশ্বরদী বেনারসিপল্লীর মাঠ পরিদর্শক আবু বকর সিদ্দিক জানান, নগদ অর্থের অভাবে তাঁতিরা কারখানা গড়ে তুলতে পারছেন না। বকেয়া বিলের কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পাবনার তাঁতি সমবায় সমিতির সভাপতি শাহজাহান আলী আশরাফি বলেন, বেনারসিপল্লীতে অনেক প্লট গ্রহীতা কিস্তির টাকা পরিশোধ করেননি। এরা প্রান্তিক তাঁতি হওয়ায় তাদের প্লট বাতিল করছে না তাঁত বোর্ড। তাঁত বোর্ডের অর্থায়নে বেনারসি কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব না। কলকাতার বাজারে ঈশ্বরদীর শাড়ির প্রচুর চাহিদা এখনো রয়েছে। কিন্তু ঈশ্বরদীতে তাঁতিদের জন্য বেসিক সেন্টার না থাকায় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁতিরা। তাদের ইচ্ছা রয়েছে এ পেশা ধরে রাখার। বর্তমানে সুতা রং জরিসহ নানা উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় শাড়ি তৈরি করতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁতশিল্পীরা।